চাঁদপুর জেলার ইতিহাস সংস্কৃতি ঐতিহ্য
রিয়াজ শাওনঃ
"আমাদের চাঁদপুর,রুপালি ইলিশে ভরপুর "
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলা হলো চাঁদপুর। উপজেলার সংখ্যা অনুসারে চাঁদপুর বাংলাদেশের একটি এর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত জেলা। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জেলা গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জেলা চাঁদপুর। এ জেলায় পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল অবস্থিত। তিন নদীর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই জেলাকে করেছে অন্যন।
শিক্ষা সাহিত্য সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্য সব দিক থেকে চাঁদপুর জেলা ষোলোআনা পরিপূর্ণ। এ জেলায় দেশের জ্ঞানী গুনী আউলিয়া দরবেশ ফকিরসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যাক্তির জম্ম হয়েছে।
চাঁদপুর জেলার ইতিহাসঃ
১৭৭৯ খ্রি. ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি জরিপকারী মেজর জেমস্ রেনেল তৎকালীন বাংলার যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তাতে চাঁদপুর নামে এক অখ্যাত জনপদ ছিল।
তখন চাঁদপুরের দক্ষিণে নরসিংহপুর নামক (যা বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন) স্থানে চাঁদপুরের অফিস-আদালত ছিল। পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থল ছিল বর্তমান স্থান হতে প্রায় ৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। মেঘনা নদীর ভাঙ্গাগড়ার খেলায় এ এলাকা বর্তমানে বিলীন হয়েছে।
বার ভূঁইয়াদের আমলে চাঁদপুর অঞ্চল বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায়ের দখলে ছিল। এ অঞ্চলে তিনি একটি শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। ঐতিহাসিক জে. এম. সেনগুপ্তের মতে, চাঁদরায়ের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর।
অন্যমতে, চাঁদপুর শহরের (কোড়ালিয়া) পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম চাঁদপুর। কারো মতে, শাহ আহমেদ চাঁদ নামে একজন প্রশাসক দিল্লী থেকে পঞ্চদশ শতকে এখানে এসে একটি নদীবন্দর স্থাপন করেছিলেন। তার নামানুসারে নাম হয়েছে চাঁদপুর। তিনি বাস করতেন পুরিন্দপুর এলাকায়। হাজীগঞ্জের ফিরোজশাহী মসজিদ মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন।
যেটি ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দেওয়ান ফিরোজখান লস্কর নির্মাণ করেছেন বলে শিলালিপি থেকে জানা যায়। হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন অলিপুর গ্রামে প্রখ্যাত মোঘল শাসক আব্দুল্লাহর প্রশাসনিক সদর দপ্তর ছিল। এখানে রয়েছে বাদশাহ আলমগীরের নামাঙ্কিত বিখ্যাত আলমগীরি পাঁচগম্বুজ মসজিদ, শাহাজাদা সুজা স্থাপিত তিনগম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মোঘল আমলের বীর সেনানায়কদের শানবাঁধানো মাজার। বর্তমানে অলিদের মাজার নামে খ্যাত। ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক পূর্ণবিন্যাসের ফলে ১৮৭৮ সালে প্রথম চাঁদপুর মহকুমার সৃষ্টি হয়। ১৮৯৬ সালের ১ অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
চাঁদপুর জেলার ভৌগোলিক অবস্থানঃ
চাঁদপুর জেলার দক্ষিণ দিকে লক্ষীপুর জেলা,পূর্ব দিকে কুমিল্লা জেলা , উওর দিকে মুন্সিগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিম দিকে বরিশাল জেলা অবস্থিত।
মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুরে অবস্থান; মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুর কত নং সেক্টরের অধীনে ছিল?
মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুর ২নং সেক্টরের অধীনে ছিল। ১৯৭১ সালের ১২ মে পাকবাহিনী হাজীগঞ্জ উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের ৫০ জন লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ গণহত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালালে পাকবাহিনীর ১৭ জন সৈন্য নিহত এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া, সূচীপাড়া এবং উনকিলার পূর্বাংশে বেলপুরের কাছে মিত্র বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষে মিত্র বাহিনীর ১৩ জন সৈন্য এবং পাকবাহিনীর ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মতলব উত্তর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
চাঁদপুর জেলার ব্যান্ডিং নাম?
চাঁদপুরকে দেশ-বিদেশে বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য ২০১৫ সালের আগস্ট মাস হতে জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শুরু করেন তৎকালিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর মণ্ডল। ইলিশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এর ব্র্যান্ডিং নাম দেন ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর । ২০১৭ সালে দেশের প্রথম ব্র্যান্ডিং জেলা হিসেবে চাঁদপুরকে স্বীকৃতি দেয়।
চাঁদপুর জেলার আয়তনঃ
চাঁদপুর জেলার আয়তন ১৭৪০৬ বর্গকিলোমিটারের। জনসংখ্যা ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী ২৬০০২৬৩ জন প্রায়। জনসংখ্যার ঘনত্ন ১৫২৬ জন প্রতি কিলোমিটারে। এখানে বসবাসরত্ব জনসংখ্যার ৯৩.৫৪% মুসলিম হিন্দু ৬.৩৮% আর বৌদ্ধ ০.০৮%।
চাঁদপুর জেলায় কতটি উপজেলা?
চাঁদপুর জেলায় ৮ টি উপজেলা রয়েছে। উপজেলাগুলো হলো চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া , মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ, হাইমচর।
চাঁদপুর জেলায় ৮ টি থানা,৭ টি পৌরসভা,৮৯ টি ইউনিয়ন, ১০৪১ টি মৌজা, ১৩৬৫ টি গ্রাম এবং ৫ টি সংসদীয় আসন রয়েছে।
চাঁদপুর জেলায় শিক্ষার হার কত?
চাঁদপুর জেলায় শিক্ষার হার ৬৯.৮ %।
চাঁদপুর জেলার সংসদীয় আসন কতটি?
চাঁদপুর চাঁদপুর জেলার সংসদীয় আসন পাঁচটি,
১ঃ চাঁদপুর সদর -হাইমচর,
২ঃ হাজিগঞ্জ-শাহরাস্তির,
৩ঃ কচুয়া,
৪ঃ ফরিদগঞ্জ,
৫ঃ মতলব উত্তর ও দক্ষিণ ,
চাঁদপুর জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হলঃ
মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ২৫০,প্রাথমিক বিদ্যালয় ১১২০ টি, মাদ্রাসা: ১,২৫৭টি,১টি চাঁদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট,১ টি মেরিন একাডেমি, ১ টি মেডিকেল কলেজ, ১টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় । সরকারি কলেজ ৭ টি, বেসরকারি কলেজ ৪৫ টি রয়েছে।
চাঁদপুরে কতটি নদী রয়েছে?
চাঁদপুরের বুক দিয়ে বয়ে চলে ৮ টি নদী। সেগুলো হলো পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া গোমতী, ধানগোদা, মতলব নদী, উধামধী, চারাতভোগ নদীগুলো প্রতিনিয়ত জেলার বুক দিয়ে বয়ে চলছে আপন গতীতে।
চাঁদপুরের অর্থনীতিঃ
চাঁদপুর জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। নদী তীরবর্তী এলাকা বলে প্রায় ৩০% মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য শিল্পের সাথে জড়িত। এছাড়াও উল্লেখযোগ্যভাবে অনেক ব্যবসায়ী বিদ্যমান। জেলা সদরে অনেক মাছের আড়ত রয়েছে, যা জেলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
চাঁদপুর শহরের বাবুরহাটে বড়বড় বহু শিল্পকারখানা রয়েছে। এই জায়গাটিকে সরকার বিসিক শিল্প নগরী ঘোষণা করে। এই এলাকাটি শুধু চাঁদপুরের নয় পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি আশীর্বাদস্বরূপ শিল্প নগরী। মেঘনার ভাঙ্গনে প্রতি বছর চাঁদপুরের আয়তন কমে গেলেও মেঘনা, চাঁদপুরের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। প্রতি বর্ষায় পানিতে ডুবে যায়,
ফলে বর্ষাকালে চাঁদপুর মাছের মাতৃভূমি হয়ে যায়। জেলার প্রধান শস্য ধান, পাট, গম, আখ। রপ্তানী পণ্যের মধ্যে রয়েছে নারিকেল, চিংড়ি, আলু, ইলিশ মাছ, সবুজ শাক-সবজি, বিসিক নগরীর তৈরি পোশাক শিল্প।
চাঁদপুর জেলার দর্শনীয় স্থান?
চাঁদপুরে রয়েছে অনেক গুলো দর্শনীয় স্থান। সারা বছরই চাঁদপুর জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো পর্যটনেী পদচারণ মূখরিত থাকে। সেই সব দর্শনীয় স্থান হলো, অঙ্গীকার স্মৃতিসৌধ,ইলিশ চত্বর,ওনুয়া স্মৃতি ভাস্কর্য,কড়ৈতলী জমিদার বাড়ি,গুরুর চর,চৌধুরী বাড়ি,তুলাতুলী মঠ,দুর্লভ জাতের নাগলিঙ্গম গাছ (জেলা প্রশাসক বাংলো),নাওড়া মঠ,পর্তুগীজ দুর্গ, সাহেবগঞ্জ, ফাইভ স্টার পার্ক, মোহনপুর পর্যটন লিমিটেড।
বখতিয়ার খান মসজিদ (কচুয়া),বলাখাল জমিদার বাড়ি,বড়কুল জমিদার বাড়ি (ভাগ্যিতা বাড়ি),বড়স্টেশন মোলহেড নদীর মোহনা (চাঁদপুর সদর),বোটানিকাল গার্ডেন,বোয়ালিয়া, জমিদার বাড়ি,মঠখোলার মঠ,মনসা মুড়া (কচুয়া),মত্স্য জাদুঘর,মেঘনা নদীর তীর (মতলব),মেঘনা-পদ্মার চর,
রক্তধারা স্মৃতিসৌধ রাগৈ মুঘল আমলের ৩ গম্বুজ মসজিদ, রামচন্দ্রপুর বড় পাটওয়ারী বাড়ী (ডাকাতিয়া নদী সংলগ্ন),
রূপসা জমিদার বাড়ি,লোহাগড় জমিদার বাড়ি,লোহাগড় মঠ,লুধুয়া,জমিদার বাড়ি,গজরা জমিদার বাড়ি,শপথ চত্বর,শহীদ রাজু ভাস্কর্য,শিশু পার্ক,সাচার রথ (কচুয়া), সাহাপুর রাজবাড়ি
হযরত শাহরাস্তি (রহ.) এর মাজার।
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ (৬ষ্ঠ বৃহত্তম), আলমগীরী মসজিদ,শাহ সুজা মসজিদ,৫০০ বছরের পুরাতন মসজিদ, মিনি কক্সবাজার সহ অনেক জায়গা।
এছাড়াও দশর্নাথীদের ভোজনের জন্য রয়েছে চাঁদপুর জেলার কিছু ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত খাবার । তার মধ্যে অন্যতম হলো ইলিশ মাছ। যার স্বাদে গন্ধে যে কোন খাদ্যপ্রিয় মানুষকে আকৃষ্ট করে পেলে অনায়াসেই।
অন্য দিকে চাঁদপুরের ওয়ান মিনিট এবং ফরিদগঞ্জ এর আউয়ালের মিষ্টির কথা দেশে বিদেশে সব জাগায় শুনা যায়।
লেখকঃ রিয়াজ শাওন
স্টাফ রিপোর্টার দৈনিক শপথ।
এডমিন, চাঁদপুরীয়ান।
Comments
Post a Comment